লালমনিরহাট বার্তা
মে দিবসের ডাকঃ ফুক্কা কুল্লে নেজামিন -আজাদ খান ভাসানী
বার্তা ডেস্ক | ১ মে, ২০২৩, ৭:১৭ AM
মে দিবসের ডাকঃ ফুক্কা কুল্লে নেজামিন -আজাদ খান ভাসানী

দুনিয়াব্যাপী পুঁজির আগ্রাসনে মে দিবসের চেতনা আজ দিকভ্রান্ত। আফসোস যাদের হাত ধরে পুঁজি বিকশিত হয়েছে, তারাই আজ কেবল পুঁজির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মওলানা ভাসানীর ভাষায়, "যে শ্রমিক কারখানায় কাজ করিয়া বড়লোকদের জন্য জীবন দেয়-তাহারা শ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না-অধিকার লইয়া সমাজে বাস করিতে পারে না-ইহার চাইতে দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? সাদা-কাপড়ী দালানবাসী মানুষের রাজ মেহনতী জনতার জন্য শুধু মাত্র দুঃখ ও দৈন্যই বহিয়া আনে। মাঠের মানুষ, কলের মানুষ, খাল-বিল আর নদী নালার মানুষের রাজ কায়েম করিতে হইবে। ইহারাই এই দেশের শতকরা ৮৫ জন। উৎপাদনশীল গঠনমূলক কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে ইহাদিগকে সংগঠিত করিয়া তাহাদের মধ্যে সংগ্রামী ও পালনবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাইতে হইবে। শ্রমজীবি মানুষের হাতে নেতৃত্ব না আসা পর্যন্ত হঠকারী ও শোষণের রাজনীতির অবলুপ্তি ঘটিবে না।" ঘটনাদৃষ্টে এখানে শ্রমিক শ্রেণীর নাম করে রাজনীতি, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, শ্রমিক সংগঠন সবই আছে। কোন কোন শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবশালী শ্রমিক নেতারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিজেদের স্বেচ্ছায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। তাদের এই অমিত প্রভাব শ্রমিক শ্রেণীর যদি কাজে লাগতো তবে শ্রমিক সমাজের চেহারাটাই বোধকরি পাল্টে যেত। প্রভাব যে কাজে লাগে না তা কিন্তু নয়; তবে তা রাজনীতির ময়দানে, ভোটের হিসাব নিকাশে।

রাস্তায় বেরুলেই শ্রমিক সংগঠনগুলোর অফিস, সাইনবোর্ড হরহামেশাই চোখে পড়ে। পহেলা মে'তে নিশ্চয়ই অনেকে ব্যানার, লাল কাপড়, স্লোগানে অস্তিত্ব জানান দিতে বাহাসে লেগে যাবেন। তাতে আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বব্যপী দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও মানবিক বিপর্যয়ে আপনারা চাল, ডাল, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন কিনা? ধনিক মালিক শ্রেণীর কাছে শ্রমিকের ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোন দাবি তুলেছেন কিনা? সরকারের সাথে শ্রমিকের স্বার্থ নিয়ে কোন দরকষাকষিতে গিয়েছেন কিনা? নাকি পুঁজির মালিক আর পুঁজি পাহারার পাহারাদার হিসেবে আপনারা নিয়োজিত রয়েছেন? এসব প্রশ্নে পহেলা মে আজ জর্জরিত।

১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোর হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে যে মে দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রতিফল নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। দেশে দেশে পুঁজির কাছে শ্রমিকের অসহায় আত্মসমর্পণ দাস প্রথাকে শ্রমদাস প্রথায় রূপান্তরিত করেছে। কেড়ে নেয়া হচ্ছে শ্রমিকের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, স্বাধীন স্বত্ত্বাকে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নের ধারণা এখন প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। পুঁজির মালিকের পক্ষে সরকারী দমন পীড়ন শাসন কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে। ফলে শোষিত বঞ্চিত এইসব মেহনতি মজলুম মানুষের মাঝে পূঞ্জিভূত চাপা ক্ষোভ দিনকে দিন বিস্ফোরণ্মূখ হয়ে উঠছে। শোষণের জগদ্দল পাথরে পিষ্ট হওয়া মানুষগুলো তাই বিদ্রোহের ক্ষণ গণনা করছে। মজলুমের গণজাগরণের নয়া সুর তাদেরকে আন্দোলন সংগ্রামের পথে অনুরণিত করছে।

১৮৮৬ থেকে ২০২৩। সময় অনেক গড়িয়েছে। কিন্তু শ্রমিকের শ্রমের মর্যাদা, ন্যায্য মজুরি এবং যুক্তিসঙ্গত কর্ম সময় নির্ধারণের মতো মৌলিক বিষয়গুলিরও আজ পর্যন্ত কোন যুক্তিগ্রাহ্য সুরাহা হয়নি। কেবল প্রলেপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। লাল পতাকা, দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগান আজো আছে। শুধু লালের চেতনা থেকে আমরা যোযন যোযন মাইল দূরে সরে এসেছি। তাই নিয়মরক্ষার মে দিবস যেন আনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে না ওঠে। এই সব আনুষ্ঠানিকতা দিন শেষে মালিকদেরকেই তুষ্ট করে বৈকি। মহান মে দিবসের ১৩৫ বছরে সমাজ সভ্যতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুঁজির একচেটিয়া বিকাশ হয়েছে। কিন্তু এতো এতো উন্নতি-অগ্রগতির কালেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি?

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ কাজ করে কৃষিখাতে। যাদের বেশিরভাগই আবার মৌসুমী বেকার। এর বাইরে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে, ৩০ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে, ৫০ লাখ পরিবহন খাতে, ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী, পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি রোলিং, মোটর মেকানিক, লবন, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা–ভ্যান চালক, ইজি-বাইক চালক, হাসপাতাল-ক্লিনিক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। তাদের জীবন জীবিকা বা অধিকার প্রতিষ্ঠায় পহেলা মে'র চেতনা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়ে আজ নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমাদের গার্মেন্ট খাতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ প্রায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। তাদের জীবনমান বলতে গেলে ১৮৮৬ সালের মতোই নাজুক অবস্থায় রয়ে গেছে। বর্তমান বাজারে সর্বনিম্ন মজুরি ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে তাদেরকে ওভারে টাইম করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মূল মজুরির দামেই তাকে দুই শিফটে কাজ করানো হচ্ছে। এটা শুভংকরের ফাঁকি। বিভিন্ন এলায়েন্স, কমপ্লায়েন্সের নাকের ডগা দিয়েই এসব চলছে। সবাই চোখে পর্দা আর কানে তুলা দিয়ে এসব আড়াল করে রাখছে। এতো এতো আইন, কনভেনশন তাহলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে?

রফিক নামের একজন গার্মেন্ট কর্মীর সঙ্গে কথা হলো। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম করোনা অতিমারীকাল থেকে অদ্যাবধি বিশ্বমন্দার অযুহাতে চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে কম বেতনে তাদেরকে অতিরিক্ত শ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে। রফিকের কথা শুনে তো আমার চোখ কপালে ওঠে গেছে! গত ক'বছর ধরে সে নাকি দিনে রাতে মাত্র চার ঘন্টা ঘুমানোর সময় পাচ্ছে। বেতন কিন্তু বাড়েনি বরং কমেছে। এর পরও মাঝে মাঝেই কারখানায় ভবনধস, আগুনের মতো দূর্ঘটনা তো লেগেই আছে। এসব ক্ষেত্রে মালিকের লোভের আগুনের বলি হচ্ছে সাধারণ শ্রমিকরা। তাজরীন, রানা প্লাজাসহ অসংখ্য কারখানার শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের আহাজারি কি আজও থেমেছে? ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অনেককেই ২০,০০০/- টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। যেখানে বর্তমান বাজারে একটি গরুর দামও গড়ে প্রায় ৮০,০০০/- টাকা! অথচ এসব নিয়ে কাউকে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। যে যেভাবে পারছে শ্রমিকদের শোষণ করে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শোষিত শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসেই একদিন এই সেক্টরে ধস নেমে আসবে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, সেদিন আমাদের প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ দম্ভ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

দেশে দেশে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ভিন্ন মোড়কে শ্রমদাস প্রথা নতুন করে ঠিকই জেঁকে বসেছে। এহেন পরিস্থিতিতে শ্রমিকের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান আর মর্যাদার লড়াই অবধারিত হয়ে পড়েছে। তাই মে দিবসের ভাবনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। শ্রমিকের রক্ত ঘামে নির্মিত সভ্যতায় তাদের হক নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্টযন্ত্র পরিচালনায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ এবং জাতীয় সংসদে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সকলে মিলে আওয়াজ তুলতে হবে- ফুক্কা কুল্লে নেজামিন, অর্থাৎ বিদ্যমান সকল শোষণ ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। অনুপ্রেরণার নাম স্পাইস। যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উক্তি করেছিলেন– 'The time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangled today.'

এই বিভাগের আরও খবর