লালমনিরহাট বার্তা
রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় মৌচাষ করে শত কোটি টাকার মধু উৎপন্নে অপার সম্ভাবনা
রংপুর অফিসঃ | ৮ জানু, ২০২২, ১০:৫৭ AM
রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায়  মৌচাষ করে শত কোটি টাকার মধু উৎপন্নে অপার সম্ভাবনা
রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় সরিষা ক্ষেত, লিচু এবং আম বাগানে পরিকল্পিত ভাবে মৌমাছির চাষ করে প্রতি বছর মধু উৎপন্নের মাধ্যমে বছরে শত কোটি টাকা অয়ের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞগন অভিমত পোষন করেছেন। এর ফলে একদিকে বিপুল সংখ্যক বেকার পুরুষ ও নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি চাষীর বাড়তি আয়ের সাথি ফসল হিসেবে নতুন সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিশাল এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হবে।
রংপুর কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অতিরিক্ত পরিচালক মাহবুবর রহমান জানিয়েছেন, গেছে রংপুর অঞ্চলের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলায় বিপুল পরিমান আম এবং লিচু বাগান ছাড়াও বিস্তীর্ন সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির চাষ করে প্রতি বছর শত কোটি টাকা মূল্যের মধু উৎপন্ন করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের কারিগরী সহযোগিতায় গত কয়েক বছর ধরে এসব জেলায় বিভিন্ন সরিষা ক্ষেত ছাড়াও লিচু এবং আম বাগানে মৌমাছির চাষ করার পাশাপাশি চাষীরা সাথি ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। চাষীদের ক্রমবর্দ্ধমান উৎসাহের কারনে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন সহ ইতোমধ্যে শতাধিক উন্নত মানের মৌবক্স সরবরাহ করা হয়েছে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের মৌমাছি চাষ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মোঃ রাকিবুলইসলাম জনান, প্রতিটি মৌবক্সে প্রতি মওসুমে নুন্যতম ১০ থেকে ২০ কেজি করে মধু পাওয়া যায়। এছাড়া মৌচাষের প্রকল্প ভুক্ত সরিষা ক্ষেতের ফলনও অন্ততঃ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ঐ এলাকায় বিভিন্ন ফলের গাছের মুকুল এবং ফসলের ক্ষেতে মৌমাছির ব্যাপক সমাগমের মাধ্যমে প্রচুর পরাগায়নের সৃষ্টি হয়। একারনে ঐসব ফলের বাগান এবং ক্ষেতের ফলনও কয়েক গুন বৃদ্ধি পায়। এই কর্মসূচীর আওতায় গত অর্থ বছরে এসব জেলার বিভিন্ন সরিষা ক্ষেতে ৩ হাজার ৫৭৪ টি মৌ বক্স স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে এই অঞ্চলে ২ হাজার ৬ শো ৯৬ টি মৌমাছির বক্স স্থাপন কারা হয়েছে। এর মাধ্যমে চাষীরা সাথি ফসল হিসেবে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরী করতে পেরে অর্থনৈতিক ভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছে। এই কর্মসূচরি আওতায় কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলায় সবচেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন হয়েছে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে- রংপুর বিভাগের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী এই ৫ জেলায় গত ২০২০-২১ রবি মৌসুমে ৩৮ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়। এসব সরিষা ক্ষেতের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে মধু উৎপন্নের লক্ষমাত্রা নিয়ে ২ হাজার ৯৫০ টি মৌমাছির বক্স স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে গোটা মওসুম জুরে কেবল মাত্র এসব সরিষা ক্ষেতে ২ হাজার ১৮৯ টি মৌ বক্স স্থাপন করে গত মওসুমে ২১ হাজার ৮০৬ কেজির বেশী পরিমান মধু উৎপন্ন হয়েছে। এছাড়া এসব জেলার বিভিন্ন আম বাগানে ২২২ টি মৌবক্স স্থাপন করে আরও ৫ হাজার ৯০৪ কেজি এবং বিভিন্ন লিচু বাগানে ২৮৫ টি মৌবক্স স্থাপন করে অতিরিক্ত ৫ হাজার ৯০৪ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে চাষকৃত সকল সরিষা ক্ষেত এবং আম ও লিচু বাগানে পরিকল্পিত ভাবে মৌচাষ প্রকল্পের অর্ন্তভুক্ত করা সম্ভব হলে এসব উৎস থেকে প্রতি মওসুমে মৌমাছির চাষ করে আরও অন্তঃত ২৫ থেকে ৩০ লাখ কেজি মধু উৎপন্ন করা সম্ভব হবে।অপর দিকে পশ্চাদ পদ এবং অবহেলিত রংপুর অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির এক অপার ভান্ডারও তৈরী হবে।
প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরের গত মওসুমে রংপুর জেলায় সরিষা চাষ করা হয়েছে ৬ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ১১০ হেক্টর জমির সরিষা ক্ষেতে ৫২ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ১৪৪ কেজি এবং জেলার ১৬৫ হেক্টর জমিতে চাষকৃত লিচু বাগানের মধ্যে ১৫৩ হেক্টরে ৮৫ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ৫ হাজার ৯০৪ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। এছাড়া ৫ হেক্টর আম বাগানে ২২ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ১৩ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ১৩ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ১ হাজার ৮৫০ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি। গাইবান্ধা জেলায় ১০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৩০০ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ৩ হাজার কেজি। জেলার ৭০ হেক্টর জমিতে চাষকৃত লিচু বাগানের মধ্যে ৫০ হেক্টরে ২০০ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ১০ হাজার কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। এছাড়া ৩০ হেক্টর আম বাগানে ২০০ টি মৌ বক্স স্থাপন করে আরও ৯ হাজার কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে। নীলফামারী জেলায় ৫ হাজার ৫’শ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধে ২৫০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ১৭ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ২৫০ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে । লালমনিরহাট জেলায় ২ হাজার ১৫৮ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হেক্টর সরিষা ক্ষেতে ৩ টি মৌ বক্স স্থাপন করে ২০ কেজি মধু উৎপন্ন হয়েছে । সীমিত পর্যায়ে মৌমাছি চাষে সাফল্য অর্জিত হওয়ায় রংপুর বিভাগের ৫ জেলায় গত রবি মৌসুমে প্রায় ৩ কোটির বেশী টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার কেজিরও বেশী মধু উৎপন্ন হয়েছে।
সিরাজগজ্ঞের মৌসুমী মৌয়াল চান মিয়া জানান, প্রত্যেক গ্রীস্ম মৌসুমে তারা এই অঞ্চলে মধু সংগ্রহের জন্যরংপুর অঞ্চলে আসেন। সাধারণতঃ এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মধু সংগ্রহ শুরু হয়। মৌয়ালরা অভিযোগ করে জানান, আমাদের দেশে আম বাগান এবং লিচু বাগানে মৌচাষ বা মধু সংগ্রহের জন্য কোন নিয়ম সৃংখলা নেই। বাজারজাত করার ব্যাপারেও কোন পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। এব্যাপারে সুষ্ঠু বাজার ব্যাবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে কেবল মৌচাষ করেই রংপুর অঞ্চলের চাষীরা শত কোটি টাকা আয় করে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সহ স্বাবলম্বি হ’তে পারবে।
রংপুর কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক দপ্তরের উপ পরিচালক মাহবুবর রহমান জানান, রংপুর অঞ্চলে লিচু এবং আম বাগান সহ সরিষা ক্ষেতে মৌচাষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ লক্ষ্যে মাষ্টার ট্রেইনার তৈরী এবং গবেষণা কার্যক্রম চলছে। এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে মৌচাষ ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে ব্যাপক সাফল্যের কাজ করছে। ফলে চাষীরাও এতে ক্রমান্বয়ে উৎসাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী চড় এলাকা সহ বির্স্তীন সরিষার ফসলের মাঠে মৌচাষে চাষিরা উৎসাহিত হয়ে তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে দক্ষ মৌয়ালের অভাবে অনেকেই কাংখিত লক্ষ্যে মৌচাষে এগিয়ে আসতে পারছেনা বলে তিনি জানান।
এই বিভাগের আরও খবর