লালমনিরহাট বার্তা
ঘরে আগুন লাগলে অন্তত জমিটা থাকে কিন্তু নদীতে তলিয়ে গেলে আর কিছুই থাকে না
- শমশের আলী ও গেরিলা লিডার শফিকুল ইসলাম কানু | ১৩ জুল, ২০২২, ২:৩০ PM
ঘরে আগুন লাগলে অন্তত জমিটা থাকে কিন্তু নদীতে তলিয়ে গেলে আর কিছুই থাকে না
দুধকুমার অনন্য বৈশিষ্টের বহুজাতিক ঐতিহ্যবাহী একটি নদ, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫৮ কিলোমিটার। তার মাত্র ৪৬ কিলোমিটার বাংলাদেশের মধ্যে, ৫৪ কি.মি. ভারতে, ১৪৫ কি.মি. ভুটানে ও ১১৩ কি.মি. তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এই নদটি প্রথমে কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারি উপজেলার শিলখুড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করে পূর্ব দিকে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং দ্বিতীয়বার একই উপজেলার তিলাই ইউনিয়নের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করেছে। তারপর, নাগশ্বেরী উপজেলার বেরুবাড়ী ও বল্লভের খাস ইউনিয়নের মধ্যবর্তি স্থান দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদ ব্রহ্মপুত্র নদের একটি দীর্ঘতম উপনদ।
এই নদটি চীনের তিব্বত মালভূমির তিনটি স্রোতধারায় সংমিশ্রণের পর আমো চু নাম ধারন করে ভুটানে প্রবেশ করেছে। তিব্বতের ইয়াদং কাউন্টিতে এই নদের তিনটি ¯্রােতধারার উৎপত্তি হয়েছে, তার একটি ইয়ারলুং জাংবো নদের একটি শাখা যা চেংবেই জিদাও নামক স্থানে উৎপত্তি হয়েছে; দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে কাম্বু মাকু যা ইয়াদং কাউন্টিতে অবস্থিত দুয়োকিং লেক থেকে প্রবাহিত আর তৃতীয় ধারার উৎপত্তি স্থল হচ্ছে মেন্দা নামক স্থানে। আমো চু ভুটানের হা-ভ্যালি দিয়ে প্রবেশ করে, ভুটানে উৎপত্তি এরকম আরো কয়েকটি উপ-নদের সাথে মিলিত হয়ে এই নদের নাম হয়েছে তোর্শা ছু। এরপরে, তোর্শা নাম ধারণ করে নদটি ভুটানের ফুন্টশোলিং এবং জয়গাঁও হয়ে ভারতের হাসিমারা সীমান্ত শহর এবং ডালসিংপাড়া এবং জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বিশাল চা বাগানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তারপর প্যাঙ্গুইল, ঘর ঘরিয়া, কালজানিসহ আরো ছোট ছোট উপনদীর সাথে মিলিত হয়ে তোর্শা নদ বাংলাদেশে দুধকুমার নাম ধারণ করেছে।
এই নদ তিব্বত মালভূমির ইয়াদং কাউন্টিতে উৎপত্তি যাকে স্থানীয় ভাষায় ড্রমো বা ট্রোমো কাউন্টি নামে পরিচিত। এই স্থানটি তিব্বতের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবেশ দার হিসাবে প্রসিদ্ধ। ইয়াদং কাউন্টি চুম্বি উপত্যকার একটি অংশ। এই চুম্বি উপত্যকা দক্ষিণে হিমালয় পর্যন্ত সিকিম এবং ভুটানের মধ্যে বিস্তৃত। তাদের ভাষা হচ্ছে তিব্বতি ও জোংখা। ভুটানের ফুন্ট শোলিং ভুটানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। তাদের ভাষা হচ্ছে নেপালী। এটি একটি উত্তাল গ্রীষ্ম মন্ডলীয় মৌসুমী জলবায়ুর এলাকা, যা দক্ষিণ এশীয় বর্ষা দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত। এখানে গড় বৃষ্টি ও তাপমাত্রার অনেক তারতম্য ও বৈচিত্র্য রয়েছে। এখানে তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং শীতকালে ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে আসে।
জয়গাঁও হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আলিপুর দুয়ার জেলার একটি প্রাচীনও কিছুটা সমতল ভূমির শহর। যা তোরশা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি ভুটান ও ভারতের আন্তঃদেশের সীমান্তে অবস্থিত। ভুটানের ভাষা হলো জংখ্যা। আর আলিপুর দুয়ার থেকে কুড়িগ্রাম জেলা পর্যন্ত জনগণের ভাষা হলো বাংলা। এইসব অঞ্চলের পলি, ঐতিহ্য ও প্রাচীন সভ্যতার বাহক হচ্ছে এই দুধকুমার নদ। তিব্বত মালভূমির মরু অঞ্চল, ভুটানের পাহাড়ি দুর্গম এলাকা ও বাংলার সমতল ভূমিকে মানুষ ও প্রাণী জগতের জন্য বসবাসযোগ্য করেছে। সকল এলাকার কৃষকগণ এই নদের দু’ধারে মনোরম ফসলের উৎপাদন করে থাকে। কখনো কখনো সেই ফসলের ভাগ আমরা যারা শহরে বসবাস করি, তারাও পেয়ে থাকি। তাই, মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে এই কৃষকগণের অবদান অনস্বীকার্য্য। গত ২৯ জুন ২০২২, আমরা এই নদ সম্পর্কে গভীর ধারণা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠির অভিজ্ঞতা জানবার জন্য শিলখুড়ী ইউনিয়নের নদী পাড়ে উপস্থিত হলে, দক্ষিণ বলডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল মজিদ, মো: ইমান আলী, মো: ইউসুফ আলী, আব্দুল কাদের, মো: আমিনুল ইসলাম, আল-আমীনসহ অনেকে তাদের কষ্টগাঁথা নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
তিলাই ইউনিয়নের কামাত আঙ্গারিয়া গ্রামে দুধকুমার নদের পাড়ে জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একটি বসত ভিটা রয়েছে। যিনি, বিৃটিশ হটাও আন্দোলেন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন, ঘেরাও আন্দোলনসহ এই ঊপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যটিন আমেরিকার মেহনতি মানুষের নেতা। জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ইংরেজ ও পাক-সরকার তাঁকে অনেকবার জেলে পাঠিয়েছিল। এলাকাবাসীর মতে, এই নদের ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে মজলুম জননেতার মওলানা ভাসানীর ভিটা ও স্মৃতি চিহ্নটুকুও রক্ষা পাবে না। এলাকাবাসী আরো বলেন যে, দুধকুমার নদের প্রবেশদ্বার কুড়িগ্রাম জেলার শিলখুড়ী ও তিলাই ইউনিয়নে বর্ষাকালে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রতিবছরই অনেক একর জমিসহ বাড়ি-ঘর তলিয়ে নিয়ে যায়। এই কারণে, অনেক ফসল মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, কৃষকের পরিবারে অভাব দেখা দেয়। অন্যদিকে, নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বিগত পাঁচ দশকে প্রায় লক্ষাধিক পরিবার নদের ভাঙ্গনে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের আর মাথা গোঁজার মত কোন জায়গা নাই। তাদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও বড় বড় শহরে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। কেউ কেউ সরকারের আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর পেয়েছে, সেখানে বসবাস করা অনেক কষ্টসাধ্য। উপরন্তু, এলাকায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হওয়ায়, শ্রমজীবি পরিবারের অসাহায়ত্ব বাড়ছে। এলাকাবাসী আমাদেরকে নদের ভাঙ্গনের চিত্র সরোজমিনে দেখিয়েছে। মূল ভুখন্ড ভেঙ্গে নদের মাঝখানে চর তৈরী হয়েছে। চরের কারনে নদ দুইভাগে বিভক্ত। নদের মাঝখানে গড়ে ওঠা চরের আয়তন দেখলে ভাঙ্গনের ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। গ্রামাঞ্চলের একটি প্রবাদ আছে; ঘরে আগুন লাগলে অন্তত ভিটা থাকে কিন্তু নদীতে তলিয়ে গেলে আর কিছুই থাকে না। যাদের ঘরবাড়ি এখনো তলিয়ে যায় নি তারা আশায় আছেন যে, মজবুত ভেড়িবাধ হলে তারা ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে। জনগণের অভিযোগ হচ্ছে, ভাঙ্গনের চিত্র যাহাই হোক জনগণের দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির চিত্র জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসছে না এবং গুরুত্বও পাচ্ছে না। যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, সিলেটের বন্যা। অথচ শিলখুড়ী ইউনিয়ন দেশের একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও পশ্চাৎপদ এলাকা। এর তিনদিকে ভারতের কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা আর মাঝখানে প্রবাহমান খরস্রোত দুধকুমার নদ। এই ইউনিয়নের মধ্যে যাতায়তের কোনো ভালো রাস্তা পর্যন্ত নেই। ভাঙ্গন ছাড়াও কয়েক বছর পরপর নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে মাঠের নিয়মিত ফসল তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এবারও মাঠের অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। মাঠের ফসল নষ্ট হলে মানুষ খাবে কি? অন্যদিকে শিলখুড়ি ইউনিয়নের পূর্বপ্রান্তে ভারতের অংশে ভাঙ্গন প্রতিরোধকল্পে বাঁধ নির্মাণের কারণে বাংলাদেশ প্রান্তে ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এলাকাবাসীর মতে, শুধু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এককভাবে ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হবে না। উভয় দেশের সম্মতিতে নদের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
আবার দুধকুমার নদের উজানে ভুটানের ডোরোখাতে আমো চু জলাধারা এবং ৫৪০ মিগাওয়াটের জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণের জন্য ভারত ও ভুটান সরকারের মধ্যে ২০০৯ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই প্রকল্পের ঠিকাদার ভারতীয় কোম্পানী এনটিপিসি। উক্ত প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। বিভিন্ন তথ্যমতে, প্রকল্পে কাজ অনেকটা এগিয়েছে। এলাকাবাসীর মতে, ভুটানের এই প্রকল্প নির্মাণ ও চালু হলে বন্যা পরিস্থিতির কি রূপ দাড়াবে বলা মুশকিল।
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, গত ২০১৯ সালে ১০ আগস্ট দুধকুমার নদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ৬৯২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প একনেক সভায় পাশ হয়। এতে ১৫টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে ২৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে উভয় তীরে নদ শাসন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদের ডান তীরে ৩৩ দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার ও ডান তীরে নতুন করে ৪ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল। অত্র এলকার জনগণ আশা করেছিল যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নদের দুই পাড়ের মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলী মাঠ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু জনগণের সেই আশার গুড়ে বালি।
এবারও শুধু শিলখুড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ বলডাঙ্গা গ্রামে প্রায় ২৫টি পরিবার নদের ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। এভাবে প্রতি বছর নদ-নদীর ভাঙ্গনের ফলে হাজার হাজার পরিবার ভূমিহীন হয়ে দেশের হত দরিদ্রের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নদী শাসনের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো স্থানে নতুন বাঁধ নির্মাণ করে সাময়িক কিছু সময়ের জন্য ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেলেও চুড়ান্তভাবে সুরক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে, একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করে কি লাভ? সরকার কেন নতুন কিছু চিন্তা করছে না? স্থানীয় জনগণ এখন আর কোনো আশা বা কারো প্রতিশ্রুতি চায় না। তারা চাই ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের যথাযথ ও মানসম্মত পূনর্বাসন।

লেখকঃ সদস্য সচিব, নদী অধিকার মঞ্চ ও সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন।
এই বিভাগের আরও খবর