লালমনিরহাট বার্তা
মানচিত্র থেকে হারানোর পর আবার সেই নদীতে চলছে নৌকা জেলেরা মাছ শিকার করছে
রংপুর অফিসঃ | ১৩ অক্টো, ২০২১, ১২:৩৫ PM
মানচিত্র থেকে হারানোর পর আবার সেই নদীতে চলছে নৌকা জেলেরা মাছ শিকার করছে
দুইশ’ বছর আগে রংপুরের মানচিত্র থেকে হারানোর পর আবার সেই নদীতে চলছে নৌকা। এখন জেলেরা মাছ শিকার করছে। সেই নদীর জলধারায় ভেসে-ভেসে আহার করছে জলচর পাখি ও হাঁস সহ নানান জাতের জলজ প্রানী।মানচিত্র থেকে হারিয়েই গিয়েছিল ‘মরা তিস্তা’ আর ঘিরনই নদী। ১৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছিল কেবল নিচুভূমি। মরা নদীতে গড়ে ওঠে বসতি ও স্থাপনা। অবশেষে দখলমুক্ত হয়েছে সেসব। নদীতে এসেছে পানির জলধারা। দুইশ’ বছর আগের মরা তিস্তা এখন জলধারায় প্রাণবন্ত হয়েছে।
এই নদীর গল্প এ প্রজন্মের বাপ-দাদারা শুনেছিল তাদেরই পূর্বপুরুষদের কাছে। আগে ছিল দুটো নদী। দুটোই হারিয়ে গিয়েছিল। বরেন্দ্র বহুমুখী কতৃপক্ষের (বিএমডিএ) দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর মরা তিস্তা ও ঘিরনই আবার জেগে উঠেছে। দুইশ’ বছর পর আবার সেই নদীতে চলছে নৌকা। জেলেরা ধরছে মাছ। পানিতে চরে বেড়াচ্ছে জলচর পাখি ও হাঁস।বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষ বলছে এবার শুধু খনন নয়, দুই পাড় সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নে তীরের পাশে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করা হয়েছে।চলতি বর্ষায় পানিতে থই- থই করছে নদী দুটোতে। বেড়েছে বক, পাতি সরালি, মাছরাঙাসহ নানান প্রজাতির পাখির আনাগোনা।
বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা আদনান আসিফ ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৭৭৬ সালের রেনেল মানচিত্রে প্রদর্শিত তিস্তা নদীর একটি শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির দক্ষিণ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলা পেরিয়ে রংপুরের তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ দিয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষভাগে করতোয়ার সঙ্গে মিশেছে।
ইতিহাসবিদ আবু জাহেদ জানান, কাগজপত্র দেখে এবং নদ-নদীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৭৮৭ সালে রংপুর সহ আশপাশের এলাকাসহ ভারতের একাংশজুড়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও বন্যা হয়েছিল। যার কারণে গতিপথ বদলে যায় তিস্তার। এতে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো স্বাভাবিক গতিপথ হারায়। মূল তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হয় মরা তিস্তা। সেটও বিলুপ্ত হয়ে যায় দ্রæত।পানি শুকিয়ে যেতেই মরা তিস্তা বেদখল হতে থাকে। গড়ে ওঠে বসতি ও স্থাপনা। শুরু হয় চাষাবাদও।আগে বন্যার সময় চিকলী ও যমুনেশ্বরীর (মরা তিস্তার শাখা) প্রবাহ থাকতো। পরে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এতে বছরে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতার শিকার হয়। নদী না থাকায় অনেক মৎস্যজীবী বদলে ফেলেন পেশা।
এমন পরিস্থিতিতে নদী উদ্ধার ও দখলমুক্তকরণে পরিকল্পনা শুরু করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তাদের উদ্যোগে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) মাধ্যমে খাল, ছোট নদী খনন কার্যক্রম শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে বদরগঞ্জের হারিয়ে যাওয়া মরা তিস্তা নদীর প্রবাহ এলাকা শনাক্ত করে চলতি বছর ফেব্রæয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার খনন করা হয়। আর এতেই নদী পানিতে ভওে ওঠে।
এ ব্যাপারে বরেন্দ্র বহুমুখী উনয়ন প্রকল্প রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান জানান, দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে অনেক নদী ভরাট হয়ে গেছে।নদী বক্ষ গোচারণ ভূমিতে পরিনত হয়েছিল। এখানে পানি বাড়লে বন্যা হতো, ফসলের ক্ষতি হতো। জলাবদ্ধ থাকা জমিগুলো এখন চাষের উপযোগী। মরা তিস্তা ও হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে।রংপুওে তিন জেলার ২০টি গ্রামের ৫ হাজার হেক্টর জমি চাষ উপযোগী হয়েছে।তিনি বলেন, ‘নদী ও বিল খননের ফলে এলাকাবাসীর দৈনন্দিন কাজে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের সুযোগ হয়েছে। স্থানীয়রা নদী উদ্ধারের সুফল ভোগ করছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নদীর দুপাশে গাছ লাগানো হচ্ছে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, ‘মরা তিস্তা ছিল অস্থি ত্বহীন। মানচিত্র ধরে এ নদীর সন্ধান করেছি। অনেকেই এটাকে বাপ-দাদার সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছিল। আর তাই নদী উদ্ধার করে খনন প্রক্রিয়া বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। আমরা এলাকাবাসীর সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। তাদের নদীর গুরুত্ব ও প্রভাব বোঝাতে পেরেছি। তাই তারা দখল করা জমি গুলো ছেড়েছেন।স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় খনন করা হয়েছে। এখন মানুষ নতুন এ তিস্তার জলধারার সুবিধা পাবেন যুগ যুগ ধরে।
বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, হারিয়ে যাওয়া ঘিরনই নদীটি করতোয়া নামে রংপুর-দিনাজপুর সীমানা বরাবর ৩৬ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বদরগঞ্জের বকসীগঞ্জ ব্রিজের উজানে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা থেকে প্রবাহিত হয়ে সোনারবান (সোনারবন্ধ) নামে অপর একটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত প্রবাহ ঘিরনই নামে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর ও লোহানীপাড়া ইউনিয়নের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউনিয়নে করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৪৮ কিলোমিটার। চলতি বছর (২০২০-২০২১) এই নদীর ৩ দশমিক ২৬৫ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়েছে। খনন করা অংশের দু’পাড়ে চারটি গ্রামের দৈনন্দিন গৃহস্থালীর কাজে নদীর পানি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কালুপাড়া ইউনিয়নের শংকরপুর ডাংগারপাড়ার গ্রামের কৃষক ওসমানী মোতালেব, আব্বাছ আলীসহ অনেকেই জানালো—‘শুনেছিলাম দাদার দাদার আমলে নদী ছিল। আমরা অনেক মাছ ধরেছি। এখন নদীতে পানি আছে। অথচ কিছু দিন আগেও এটা ছিল খালের মতো। নদীর পাশে যারা চাষ করতাম তাদের জন্য সুবিধা হয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান,এ অঞ্চলের কৃষি, জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশের অভাবনীয় ফল বয়ে আনবে মরা তিস্তার এই পুনরুদ্ধার প্রকল্প।
এই বিভাগের আরও খবর