লালমনিরহাট বার্তা
বুদ্ধজিীবী হত্যাকাণ্ড: বাঙালি জাতকিে মধোশূন্য করার ঘৃণ্য কৌশল -মোঃ মামুন অর রশদি
বার্তা ডেস্কঃ | ১৪ ডিসে, ২০২১, ১১:২২ AM
বুদ্ধজিীবী হত্যাকাণ্ড: বাঙালি জাতকিে মধোশূন্য করার ঘৃণ্য কৌশল -মোঃ মামুন অর রশদি
একটি মানুষের শরীরে মস্তিষ্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ অংশ, রাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিজীবীগণ ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় অংশ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অপরিসীম।মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরোচিত ও নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশনা ও এদেশীয় এক দালাল শ্রেণির সহযোগিতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবেহত্যা করা হয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ

বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব-বাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যেই বাঙালিরা ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। আর এর পেছনে মূল প্রেরণা জোগান ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ষাটের দশকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্নভাবে কর্যকর ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই পাকিস্তানি শাসকদের বিরাগভাজন ছিলেন। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়ায় পরিণত করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা করা হয় এবং তা বাস্তবায়ন করা হয়।

শহিদ বুদ্ধিজীবী’র সংজ্ঞা নির্ধারণ

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে সরকারের ৫০ বছর লাগল। ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় “শহিদ বুদ্ধিজীবী”-দের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করে। সংজ্ঞা অনুযায়ী,
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহিদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁরা শহিদ বুদ্ধিজীবী।”

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা

সব শহিদ বুদ্ধিজীবীর পরিচয় দূরের কথা, তাঁদের প্রকৃত সংখ্যাই নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত করা হয়নি। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করে। এতে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা রয়েছে।এতে মোট ৯৮৯ জন শিক্ষাবিদসহ মোট ১,১০৯ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী মোট ৬৩৯ জন প্রাথমিক, ২৭০ জন মাধ্যমিক, ৫৯ জন কলেজ, ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ ৯৮৯ জন শিক্ষাবিদ শহিদ হন। এছাড়া ৪১ জন আইনজীবী, ৫০ জন চিকিৎসক, ১৩ জন সাংবাদিক, ১৬ জন কবি-সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মকর্তা শহিদ হন। তদুপরি এ তালিকায় রয়েছে ৮ জন শহিদ গণপরিষদ সদস্যের নাম।
বাংলাপিডিয়ার বর্ণনামতে, প্রাপ্ত তথ্যসূত্র থেকে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মোটামুটি একটা সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী ও অন্যান্য ২ জন মোট ১,১১১ জন।

পরবর্তীকালে মাঠ পর্যায়ে অনুসদ্ধানের ফলে আরো অনেক শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নাম পাওয়া গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ আইনজীবী গ্রন্থে ৬৪ জন শহিদ আইনজীবীর তালিকা রয়েছে।

২০২০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন করেছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশার বাস্তবায়ন

সারা দেশে বুদ্ধিজীবী নির্মূল অভিযানের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী একযোগে গণহত্যা পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে অন্যূন দশ জনের একটি কমিটি কর্তৃক বুদ্ধিজীবী নিধনের নীলনকশা প্রণীত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গভর্নর হাউজে ফেলে যাওয়া রাও ফরমান আলীর ডায়েরির পাতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায় যাঁদের অধিকাংশই ১৪ই ডিসেম্বরে নিহত হন। পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর সার্বিক নির্দেশনায় নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেজাজী, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাইউম। আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডাররা পাকবাহিনীর অস্ত্র সাহায্য নিয়ে তাদেরই ছত্রছায়ায় এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুধু ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হয়নি, সুপরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়েছে। বুদ্ধিজীবী নির্মূল অভিযানকে ৩ পর্বে ভাগ করা যায়।

প্রথম পর্ব
প্রথম পর্ব ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলে। প্রথম পর্বে হত্যার শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়াও দেশের কয়েকজন খ্যাতিমান আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনীতিবিদ। তাঁরা শহিদ হন প্রধানত পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার অংশ হিসেবে।

২৫শে মার্চ গণহত্যার সূচনা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রছাত্রীরা আক্রমণের শিকার হন। ঢাকার জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক হলে প্রায় ৫০০ জন ছাত্র হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ এরপর বাংলাদেশের সর্বত্রই চালানো হয়।

২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা রাতে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতেই আক্রমণ চালায়নি, হানা দেয় তারা শিক্ষকদের বাড়িতে বাড়িতে। ২৫ মার্চের রাতে পাক সেনারা হত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে।

দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব চলে মে-নভেম্বর মাস পর্যন্ত। এ পর্বে প্রকাশ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কম হলেও গোপনে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবী নিধন চলে। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা গণ-আন্দোলনের সময়ই প্রস্তুত করা হয়েছিল।এ পর্বে তাঁদের হত্যার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজাকারদের উদ্ধারকৃত ডায়েরি থেকে বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট হয় বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বাঙালিকে পঙ্গু করাই ছিল হত্যার প্রধান উদ্দেশ্য।

চূড়ান্ত পর্ব

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পর্ব ছিল ১০ই ডিসেম্বর থেকে চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত। হানাদাররা পরাভূত হবে কিংবা মাত্র ৯ মাসের মধ্যে তাদের ভরাডুবি হবে একথা কল্পনাও করেনি। সেজন্য পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলেও বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়। ৩রা ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ আক্রমণের মুখেও তাদের টনক নড়েনি। কারণ তখনো মার্কিন সপ্তম নৌবহরের আগমন তাদের শেষ ভরসা ছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পরাজয় নিশ্চিত জেনে আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় ১০ই ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডদ্রুত ঘটানো হয়। পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১, যে দিন তারা একমাত্র ঢাকা নগরীতেই দুইশতও বেশি বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে আরো অনেক বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়। আবার কারো কারো লাশও পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর লাশের স্তূপে যাঁদের পাওয়া গিয়েছে তাঁদের সকলের হাত-পা-চোখ বাঁধা ছিল। কারো হাত নেই, কারো চোখ বা হৃৎপিণ্ড নেই। এগুলো নরপিশাচদের নির্যাতনের স্বাক্ষর বহন করে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ বাংলাদেশের সর্বত্র সংঘটিত হয়। এ যজ্ঞে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, রাজনৈতিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কেউ বাদ পড়েনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড়ো ভূমিকা ছিল।এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্যবস্তু। যদিও নয় মাস শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়, সমগ্র বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের আক্রোশ ছিল এবং এ কারণে পরিকল্পিতভাবে এ সম্প্রদায়কে নিধনের সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকাংশে তারা সফলও হয়। যদিও ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের পরিকল্পনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ শিক্ষকদের ২১ জনের মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ জন শহিদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ফজলুর রহমান খান, শরাফত আলী, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, অধ্যাপক রাশেদুল হাসান, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক সায়েদুল হাসান অন্যতম শহিদ বুদ্ধিজীবী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুম, হাবীবুর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার-এই তিনজন শহিদ হন। মানবদরদি চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, গোলাম মোর্তজাকেও ঘাতকরা রেহাই দেয়নি। জনগণের পক্ষে লেখার কারণে হত্যা করা হয় সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমদ, গোলাম মোস্তফা, নাজমুল হক, মেহেরুন্নেসা, শহিদ সাবেরকে। হত্যা করা হয় আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নাজমুল হক সরকার, আবদুল জব্বার, আমিন উদ্দিনকে। প্রকৌশলী সামসুদ্দিন, নজরুল ইসলাম, সেকান্দার হায়াত চৌধুরী, চলচ্চিত্র ও গানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, কিংবা সাহিত্যিক ইন্দু সাহা, সেলিনা পারভীনও বাদ পড়েনি হায়েনাদের বুলেট থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে যথার্থ ভূমিকাই রেখেছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, দীর্ঘকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যেসব বুদ্ধিজীবী জড়িত ছিলেন তাঁরাও যেমন মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ে জড়িত ছিলেন না তাঁরাও এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। অবশ্য বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা শুধু যুদ্ধের নয় মাসেই সীমিত ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে, পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাছিলেন অনুপ্রেরণাদানকারী, কেউ কেউ ছিলেন সামনের কাতারে। বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচারের বিষয় সাধারণ মানুষকে অবগত করেছিলেন তাঁরা। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ যে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এটা সকলেরই জানা ছিল। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা সেই সত্যটা আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তাঁরাই প্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি চালুর কথা বলেছেন। বাঙালি সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন আন্দোলনের প্রতিটি খবর, শিল্পী-সাহিত্যিকরা গল্প, উপন্যাস, নাটক, গানসহ লেখনীর মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক, মৌলিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রতি সচেতন করে তুলেছেন।এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরা।

১৯৭১ সালে যখন গণহত্যা শুরু হয় তখন বাংলাদেশের মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিকভাবে বেজেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে ছিল এ ঘটনার পর নিশ্চিত জেনেছে যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বাঙালির বাঁচার উপায় নেই। বুদ্ধিজীবীদের বড়ো অংশ তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া বুদ্ধিজীবীরা গড়ে তুলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’, যার সভাপতি ছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। এছাড়া তাঁকে সভাপতি এবং জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ’। বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেল গঠন করে। বিশ্বে বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সরবরাহ ও বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, সংসদীয় পার্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ, সাহায্যের আবেদন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য প্রদান, শরণার্থীদের উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁরা ভূমিকা রাখেন। শরণার্থী শিবির শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ৫৬টি স্কুল খুলে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, যা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার উৎস ছিল। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন।

সমাপনী কথা

সকল দিক থেকে বাংলাদেশের মস্তিষ্ক ধ্বংস করাই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর উদ্দেশ্য। স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বুদ্ধিজীবী নিধন করা হয়। পাকিস্তানিদের এ উদ্দেশ্য আংশিকভাবে সফল হয়। বিভিন্ন পেশার লোকদের বেছে বেছে মেরে ফেলায় বাঙালি জাতি সাময়িকভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকটের সম্মুখীন হয়। জহির রায়হানের মতো কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার, মুনীর চৌধুরী ও আনোয়ার পাশার মতো সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো প্রাজ্ঞ আইনজীবী অথবা আলিম চৌধুরী ও ফজলে রাব্বীর মতো চিকিৎসক থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আরো উপকৃত হতো। গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মতো মানবতাবাদী দার্শনিক, আলতাফ মাহমুদের মতো সুরকার ও শিল্পী, নিজামুদ্দিন, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো সাংবাদিক একদিনে গড়ে ওঠেন না। এঁদের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি বাঙালি জাতিকে বহন করতে হয়েছে।

যে-কোনো দেশে চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে অগ্রসর শ্রেণি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। নতুন প্রজন্মকে বুদ্ধিজীবীদের মহান আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানাতে হবে। আমরা যদি বাংলাদেকে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারি এবং জাতি হিসেবে যদি আমরা শিক্ষিত, মানবিক ও দেশপ্রেমিক হতে পারি, তাহলেই কেবল বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক: জেলা তথ্য অফিসার, লালমনিরহাট
ইমেইল: diolalmonirhat57@gmail.com
এই বিভাগের আরও খবর