লালমনিরহাট বার্তা
ইত্তেফাক ও মওলানা ভাসানী ।। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রসঙ্গ
আজাদ খান ভাসানী | ২১ আগ, ২০২৩, ৭:০১ AM
ইত্তেফাক ও মওলানা ভাসানী ।। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রসঙ্গ

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাঙালি জাতির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেদিনটিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। সেই সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের সমর্থক কোনো পত্র-পত্রিকা ছিল না। তাই মওলানা ভাসানী ‘ইত্তেফাক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের ঘোষণা দেন।দলের সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে সাধ্যমতো চাঁদা দেওয়ার আবেদন জানান। সেই সভাতেই প্রায় সাড়ে চারশ টাকার মতো তহবিল সংগৃহীত হয়। দেশের অন্যান্য জায়গা ঘুরে তিনি আরও কিছু অর্থ সংগ্রহ করেন। সেই টাকায় ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট সাপ্তাহিক ইত্তেফাক আত্মপ্রকাশ করে। ঢাকার তৎকালীন অ্যাডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট আলী রেজার নিকট থেকে মওলানা নিজ নামে মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ডিক্লারেশন নিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রথম ছাপাখানা ও অফিস হিসেবে আছগর হোসেন এমএলএ-এর ৭৭ মালিটোলা বাসভবনটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

এরপর ঢাকার কলতাবাজারে অবস্থিত করিম প্রিন্টিং প্রেস থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারি হয়রানির ভয়ে মুদ্রণালয়গুলো ইত্তেফাক ছাপাতে অস্বীকার করলে এর কার্যালয় পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাতেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় পুনরায় সরকারি অনুমোদনকালে মওলানা ভাসানী পত্রিকাটির প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে নিজের নামের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খানের নাম যুক্ত করেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানী এবং প্রকাশক, মুদ্রাকর ও সম্পাদক হিসেবে ইয়ার মোহাম্মদ খানের নাম প্রকাশ হতে থাকে। তখন ৯নং হাটখোলা রোডে অবস্থিত প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে তখনকার এই সাপ্তাহিকটি মুদ্রণ হতে থাকে। আর ৯৪নং নবাবপুর রোডের ঠিকানাটি প্রকাশনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ইতোমধ্যে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার পর খয়রাত হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইয়ার মোহাম্মদ খানের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সেই বৈঠকে ইত্তেফাক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এর আগে তফাজ্জল হোসেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সমর্থকে পরিণত হন। তার এই সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ও দলীয় সমর্থনের বিষয়টি বিবেচনা করে মওলানা ভাসানী তাকে ইত্তেফাকে সংশ্লিষ্ট করেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, তিনি হবেন পত্রিকাটির সম্পাদক। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট মানিক মিয়া ইত্তেফাকের নতুন সম্পাদক নিযুক্ত হন। অবিলম্বে মানিক মিয়ার চৌকস সম্পাদনা, ইয়ার মোহাম্মদ খানের সুদক্ষ পরিচালনা এবং আবদুল ওয়াদুদ, আবদুল আওয়াল ও নুরুল ইসলামের সক্রিয় সহযোগিতায় ইত্তেফাক জনপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয়।

উল্লেখ্য, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ঢাকায় ফিরে প্রথম দিকে বেকার জীবন যাপন করতেন। তার উৎসাহ এবং বেকারত্ব উভয় দিক বিবেচনা করেই মওলানা ভাসানী তাকে ইত্তেফাকের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তাছাড়া সংবাদিক হিসেবে তখন তার সুখ্যাতিও ছিল। শুরুতে তার পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছিল মাত্র ষাট টাকা। তদুপরি সামান্য এই পারিশ্রমিক নিয়মিত প্রদানেরও কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তাই মওলানা ভাসানী ইত্তেফাকের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতেন তা সম্পাদকের হাতেই তুলে দিতেন। যার বেশিরভাগ টাকাই পত্রিকার প্রকাশনার কাজে ব্যয় হয়ে যেত। উদ্বৃত্ত অর্থ তফাজ্জল হোসেন নিষ্ঠার সঙ্গে রেখে দিতেন ভবিষ্যতে দলের বিপদ-আপদের জন্য। এছাড়া ইয়ার মোহাম্মদ খান, আজগর আলী শাহ (পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তদানীন্তন সেক্রেটারি) এবং পরবর্তী সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ইত্তেফাকের জন্য অর্থ জোগান দিতেন।

ইত্তেফাকের শুরুর দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হননি। তিনি তখন জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ করতেন। ইত্তেফাক সম্পাদকের সামান্য পারিশ্রমিক প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করতে না পারলেও মওলানা ভাসানী ঢাকার জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তখনকার আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে ‘মানিক ভাই গরিব মানুষ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরাই তার বিড়ি-সিগারেট, কাপড়-চোপড়ের খরচ বহন করতেন। এভাবেই সে সময় ইত্তেফাক নিয়মিত প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছিল। সে সুবাদে তফাজ্জল হোসেনেরও ঢাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করার পথ প্রশস্ত হয়েছিল।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ইত্তেফাককে দৈনিকে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিকে রূপান্তর হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াই দৈনিকের সম্পাদক নিযুক্ত হন। আবার দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হওয়ার পরও গ্রামের সাধারণ মানুষ, যাদের দৈনিক কাগজ কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের স্বার্থে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকও নিয়মিত প্রকাশের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সাপ্তাহিকটির সম্পাদক নিযুক্ত হন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। এই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১৫৭ জন পাকমার্কিন সামরিক জোটের (সিয়াটো-সেন্টো) বিরোধিতা করে পক্ষে বিবৃতি দেন। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীপন্থিদের পক্ষ নিয়ে ইত্তেফাক তার প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ থেকে বেরিয়ে যায় এবং পাকমার্কিন সামরিক চুক্তির পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রবন্ধনিবন্ধ প্রকাশ করতে থাকে। পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করে। ইয়ার মোহাম্মদ খান এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হন। এমন একটি অবস্থায় ঢাকা জেলার তদানীন্তন প্রশাসক সিলেট নিবাসী ইয়াহিয়া চৌধুরী ১৯৫৪ সালের ১৪ মে গভীর রাতে ইয়ার মোহাম্মদ খানের অজ্ঞাতসারে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে ইত্তেফাকের প্রকাশক ও মুদ্রাকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসময় হঠাৎ করেই একদিন দেখা গেল যে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম আর নেই। মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে এই পরিবর্তনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

অবশ্য নাম বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইত্তেফাক মওলানা ভাসানীর কঠোর বিরোধিতা শুরু করেনি। কঠোর বিরোধিতা শুরু হয়েছিল এরও অনেক পর, ১৯৫৭ সালের দিকে। কাগমারী সম্মেলনের সাফল্য সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদে পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। দৈনিক সংবাদ কোনোদিনই সোহরাওয়ার্দীর কুৎসা রটিয়ে বা তাকে এতটুকু খাটো করে কোনো মন্তব্য করেনি। সোহরাওয়ার্দীও মওলানা ভাসানী সম্পর্কে প্রকাশ্যে কটূক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করেননি। কিন্তু ইত্তেফাক কাগমারী সম্মেলনের পরের দিন থেকে মওলানার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার পথ বেছে নেয়।

এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে সংবাদপত্রের উদ্দেশে প্রেরিত এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, “আমি সাপ্তাহিক ও দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম কিনা, তাহা সরকারী দপ্তরে এবং উভয় পাকিস্তানের হাজার হাজার ইত্তেফাক পাঠকের ঘরে পুরাতন কাগজ অনুসন্ধান করিলেই দেখিতে পাইবেন। সাপ্তাহিক এবং দৈনিক ইত্তেফাকে বড় অক্ষরে লেখা থাকিত ‘প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী’। আলী রেজা অ্যাডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা কোর্টে আমি সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক, মাসিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত হই। পরে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের ডিক্লারেশন ইয়ার মোহাম্মদ খানের নামে পরিবর্তন করি। কী কারণে কী অবস্থায় আমার কাগজ আমার বিনানুমতিতে হস্তান্তরিত হইয়াছে, তাহাও আজ পর্যন্ত আমি কাহারও নিকট ব্যক্ত করি নাই। কিন্তু প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক আমি ছিলাম, তাহা পাকভারতের কোটি কোটি মানুষ অবগত আছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী আওয়ামী সম্মেলনে যখন আমি পাক-মার্কিন যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়া বৈদেশিক নীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করার প্রস্তাব করি, তখনও আমার বিরুদ্ধে দেশময় প্রচার করা হয় যে, আমি হিন্দুস্তানের দালাল ও হিন্দুস্তানের অর্থে রাজনীতি করি। বর্তমানেও এক শ্রেণীর লোক প্রচার করিতেছে যে, বিভিন্ন লোকের নিকট হইতে আমি লক্ষ লক্ষ টাকা পাইয়াছি। এই অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পাকিস্তান সরকার ও দেশবাসীর নিকট দাবী করিতেছি যে, আপনারা সারা পাকিস্তান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করুন যে, আমার নিজস্ব বাড়ী-ঘর, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কোনো ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে কিনা!...”

এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ইত্তেফাক প্রকাশনায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া যে শ্রম দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন জাতি তা অবশ্যই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। কিন্তু ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত।

লেখক: সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ।

এই বিভাগের আরও খবর