বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ সারাদেশ

রংপুর মেডিক্যালে ক্যান্সার থেরাপির যন্ত্র কোবাল্ট মেসিন৬০- দীঘ ১০ বছর ধরে অচল


প্রকাশ :

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার থেরাপি যন্ত্র কোবাল্ট-৬০- দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু হয় ২০০১ সালের দিকে। ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ কোবাল্ট-৬০ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে কয়েক বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও সেটা চালু করা আজও সম্ভব হয়নি।বর্তমানে হাসপাতালের আউটডোরে ৪টি বেড ও ভর্তি রোগীর ১০টি বেডে কেমোথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মানুষের চিকিৎসার স্বার্থে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোবাল্ট-৬০ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের প্রবেশ মুখেই রয়েছে এই রেডিওথেরাপি বিভাগ। ভবনের একটি কক্ষে কোবাল্ট-৬০ যন্ত্রটি অযত্নে পড়ে আছে। পাশের কক্ষে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কয়েকটি মনিটর। কাপড়ের ওপর ধুলোর আস্তর জমে আছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসক মনি রানী জানান, ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৯০ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। গড়ে কেমোথেরাপি নেন ৪০ জন। অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি থাকেন ১০ থেকে ১৫ জন। এ হিসাবে বছরে অন্তত ৪০ হাজার ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশের রেডিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি আছে- অপারেশন, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। রেডিওথেরাপি ক্যান্সারের একটি অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। রেডিওথেরাপি এককভাবে অথবা অপারেশন বা কেমোথেরাপির সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়।যেসব ক্যান্সারের জন্য রেডিওথেরাপি চিকিৎসা জরুরি সেগুলো হলো মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ব্রেনের ক্যান্সার, জরায়ু ও জারায়ু মুখের ক্যান্সার, মলদ্বারের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও ত্বকের ক্যান্সার। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রেডিওথেরাপির পাশাপাশি ব্রেকিথেরাপি ও লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর মেশিন প্রয়োজন সে যন্ত্র নেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

মেডিকেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রংপুরে বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলা থেকে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের রোগী ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের রোগী ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, গ্রুপ হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনালীর ক্যান্সারের রোগী ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও শ্বাসতন্ত্রের ক্যান্সারের রোগী ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত ছয় হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২৩ সালেই ২ হাজার ৮৪৬ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের থেরাপি দেওয়ার একমাত্র মেশিন হচ্ছে কোবাল্ট-৬০ (টেলিথেরাপি)। যন্ত্রটি ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। হাসপাতালে নতুন টেলিথেরাপি মেশিন স্থাপনের কথা থাকলেও কবে নাগাদ তা হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।মাত্র দু'জন চিকিৎসক নির্ভর ১৪ শয্যার কেমোথেরাপি  বিভাগ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।১৯৯৭ সালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন ও চালু করা হয়।চীনের তৈরি এই মেশিনগুলো সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকার ‘মার্ডেল এজেন্সি’ সরকারের কাছে অনুমতি পায়। এই কোবাল্ট মেশিন চীন থেকে আনা হলেও ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যে সোর্স (যে উৎস থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ ঘটে) তা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে।প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই সোর্স পরিবর্তন করতে হয়। কারণ, এর কার্যকারিতা পাঁচ বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এরপর তা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।কোবাল্ট মেশিনটিতে সর্বশেষ সোর্স স্থাপন করা হয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালে নতুন করে সোর্স স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি। ক্যান্সার রোগীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রটি দিয়ে গত বছর ১৫ মার্চ পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। কার্যাদেশে চারটি মেশিনের আনুষঙ্গিকসহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ ১১ হাজার ২৩২ মার্কিন ডলার। পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাসহ বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৭৬ টাকা। 

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ক্যান্সার রোগীদের দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষা। অনেকেই ক্যান্সার কেমোথেরাপি নিচ্ছে। তাদের একজন কে  হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই ক্যান্সারের কেমোথেরাপি নিচ্ছে। তাদের একজন হাফিজুর রহমান (৪৯)। তিনি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা থেকে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য এসেছেন। তিনি প্রায় দেড় মাস সেখানে হোটেলে থেকে ৩০ সাইকেল থেরাপি নিয়েছেন। এতে তার চিকিৎসার খরচ বেড়ে গেছে। রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দ্রুত চালু করা গেলে তার মতো অন্যরাও উপকৃত হবেন বলে মনে করছেন।একই জেলার তেঁতুলিয়া থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মিজানুর রহমান (৫৫) জানান, গলায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। অস্ত্রোপচারের পর ছয় সাইকেল কেমোথেরাপি নিয়েছেন। কিন্তু টাকার অভাবে রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন না।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহান আফরোজ লাকি বলেন, সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর রেডিওথেরাপি বাবদ প্রতি ধাপে খরচ হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ হয় ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে রোগের ধরন অনুযায়ী ২৫ থেকে ৩০ দিন রেডিওথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হয়।ক্যান্সারের রোপপগীর যে কষ্ট, যে ধরনের চিকিৎসা-ফলোআপ, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না।এখনা  রোগীরা এখানে সুন্দর পরিবেশে কেমোথেরাপি নিতে পারবেন। বর্তমানে পুরুষদের ফুসফুস ও নারীদের জরায়ু, নাক, কান ও গলায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, নতুন রেডিওথেরাপি মেশিনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিগগিরই কথা বলা হবে।কোবাল্ট যন্ত্রটি চালু করার জন্য আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগের পরিচালকরাও একাধিকবার চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।