ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ঘটনাও দিনদিন বাড়ছে। তারই অংশ হিসাবে বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে দুর্যোগের তীব্রতা। এ দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, নদীভাঙ্গন, শৈত্যপ্রবাহ-সহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করছে। এছাড়াও এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ, নদীশাসন, বৃক্ষনিধন প্রভৃতি মানবসৃষ্ট কারণেও দেশে দুর্যোগের তীব্রতা বেড়েছে কয়েক গুণ।
জার্মান ওয়াচের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকির ২০২৪ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড়ো বাধা এই দুর্যোগ। একটি মাত্র দুর্যোগ দেশকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই দেশের উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখতে প্রয়োজন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বাধা দেওয়া বা বন্ধ করা যায় না, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি এবং তীব্রতা প্রশমন করা যায় মাত্র। তাই দেশের চলমান গতি ঠিক রাখার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই দুর্যোগ মোকাবিলায় নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়। যা ক্রমেই রূপান্তরিত হয়ে ২০১২ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় হিসাবে পুনর্গঠিত হয়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ অনুযায়ী দুর্যোগ মোকাবিলায় পাঁচটি ধাপ বা স্তর রয়েছে। ধাপগুলোর মধ্যে রয়েছে, সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসকরণ, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সঠিক আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ, কোনো আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে জীবন ও সম্পদের রক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা নিশ্চিতকরণ, দুর্যোগকালীন অবস্থায় জরুরি সাড়াদান এবং সবশেষে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ।
বাংলাদেশ সরকার দুর্যোগ মোকাবিলার সকল কার্যক্রম এবং ধাপকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে ২০১২ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে, যা ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ নামে পরিচিত। এই আইনের বলে দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস-সহ জরুরি মানবিক সহায়তা, পুনরুদ্ধার এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালনার নিমিত্তে ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্যোগের বিপদাপন্নতা হ্রাস করা, বিশেষভাবে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য কার্যকর মানবিক সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করা, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং জরুরি সাড়াদানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি এবং দাতা সংস্থাসমূহ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এছাড়াও এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে ‘জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট’ নামে একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-সহ নানা ধরনের দুর্যোগ প্রশমনের ব্যাপারে গবেষণা করে। যে-কোনো দুর্যোগ দ্রুত মোকাবিলা করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ। পাশাপাশি, সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে রয়েছে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল’।
এছাড়াও ১৯৭২ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি প্রোগাম। এই প্রোগ্রাম ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক সতর্কতা, আশ্রয়, প্রাথমিক চিকিৎসা, অনুসন্ধান ও উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ এবং পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইন, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য এসব দপ্তর-সংস্থা যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন, জরুরি মানবিক সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম-সংক্রান্ত নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ডাটাবেস প্রস্তুত ও সংরক্ষণ, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সমন্বয় রক্ষা, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি। এছাড়াও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসকল্পে সরকারের রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ প্রজেক্ট। যেমন, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা), গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টেস্ট রিলিফ), দুঃস্থদের খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ), জিআর (খাদ্য), নগদ অর্থ সহায়তা (জিআর), শীত বস্ত্র সহায়তা, অতি দরিদ্রদের ঝুঁকিহ্রাসকল্পে বছরের বিভিন্ন সময়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রভৃতি।
দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচারে জেলা তথ্য অফিসসমূহ, রেডিও ও টেলিভিশন কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক, দ্রুত ও অধিকতর কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে দুর্যোগ-সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য ও সহযোগিতার জন্য টোল ফ্রি ১০৯০ নম্বর চালু করা হয়েছে। এছাড়াও, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৩২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার করা হচ্ছে৷ স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেশের ৬৪টি জেলায় নির্মাণ করা হয়েছে জেলা ত্রাণ গুদাম এবং জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র।
সম্মিলিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। যেমন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রায় ২৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান। পাশাপাশি ভূমিকম্পসহ বড়ো ধরনের দুর্যোগ-পরবর্তী অনুসন্ধান, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সমন্বিতভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সেন্টার হিসাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার। এছাড়া বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে ও পূর্বাভাস প্রদানের নিমিত্তে ‘হাওরঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ এবং ‘বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দেশব্যাপী বজ্রনিরোধক কাঠামো স্থাপন’ শীর্ষক দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগকবলিত মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ৬০টি বিশেষ ধরনের নৌকা তৈরি ও হস্তান্তর কার্যক্রম চলমান। দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্র ৩২৭টি, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্র ১৪১১টি, গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্র ৫টি এবং অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্র ৩২০৬টি।
যদিও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবু দুর্যোগ প্রশমন এবং দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের ক্ষেত্রে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। শুধু আইনের প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব পালনও দুর্যোগ প্রশমনে বড়ো ভূমিকা পালন করে। অপরিকল্পিত স্থাপনা, বিল্ডিং কোড না মানা, পরিবেশ দূষণ, অপরিকল্পিত বৃক্ষনিধন ও বন উজাড়, জলাধার ভরাট, পাহাড় কাটা, অনিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিকতা সবই দিনে দিনে দুর্যোগের প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলছে কয়েক গুণ। একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব হলো, এসব কাজ থেকে নিজে বিরত থাকা, অন্যকে বিরত রাখা। পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা ক্যাম্পেইন, পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ব্যবহার প্রভৃতি কার্যক্রম দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় তরুণদের উদ্যোগে গঠিত হতে পারে স্থানীয় যুব উন্নয়ন সমিতি, যা স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সর্বোপরি সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে দুর্যোগের ক্ষতি থেকে দেশকে ও নিজেকে রক্ষা করতে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। তাই জনগণের জানমাল রক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সঠিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। শুধু সরকারের উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজন কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের সঠিক পদক্ষেপ এবং জনসচেতনার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হবে টেকসই ও উন্নত বাংলাদেশ।
লেখক :ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী, বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা এবং তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত।