৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ইউনেস্কো কতৃক স্বীকৃত ১৯৯৪ সাল থেকে এ দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে, এদিন শিক্ষকবৃন্দের অবদান ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি বিশেষ দিন। ২০২৪ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের থিম বা প্রতিপাদ্য "Valuing teacher voices: towards a new social contract for education" অর্থাৎ “শিক্ষকের কন্ঠস্বরঃ শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার।“ এখানে শিক্ষাগত নীতি এবং অনুশীলনগুলি গঠনে শিক্ষকদের কণ্ঠের গুরুত্বের উপর জোর দেয়া হয়েছে, শিক্ষাকে ঘিরে সামাজিক চুক্তির পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে। শিক্ষকদের সমাজে অপরিহার্য অবদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি, শুধুমাত্র নির্দেশের ক্ষেত্রে নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রভাবক হিসেবে। শিক্ষাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য শিক্ষকদের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব, এবং শিক্ষাগত কৌশলগুলিতে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে সমর্থন করে। শিক্ষায় অসমতা, শিক্ষকের ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ত পেশাগত বিকাশের সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা করা, যা শিক্ষকদের কার্যকরভাবে সম্পাদন করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।একটি "নতুন সামাজিক চুক্তি" এর পরিপ্রেক্ষিতে, এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে আরও অভিযোজিত, প্রতিক্রিয়াশীল এবং সকলের জন্য উপকারী তা নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের (সরকার, শিক্ষাবিদ, ছাত্র এবং সমাজ) মধ্যে সমতা, অন্তর্ভুক্তি এবং সহযোগিতার উপর জোর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই দিবসের গুরুত্ব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, “বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২৪” যথাযথ মর্যাদায় দেশের সকল উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে উদযাপনের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের “মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ” গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রি. একটি নীতিমাল প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে জেন-জি ও আলফা প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সমৃদ্ধতার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেন-জি প্রজন্ম(জন্মঃ ১৯৯৭-২০১২ পর্যন্ত) এবং আলফা প্রজন্ম (জন্মঃ ২০১৩-বর্তমান) এরা এমন এক প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির যুগে বেড়ে উঠছে। এরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং জ্ঞান আহরণের দিকে ঝুঁকছে।
শিক্ষকের ভূমিকা
প্রযুক্তির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে সংযুক্ত আমাদের জেন-জি ও আলফা প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। তাই তাদের শেখানোর জন্য শিক্ষকদের প্রযুক্তির দক্ষতা অর্জন অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের শিক্ষকবৃন্দ বিভিন্ন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এবং মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষার নতুন পদ্ধতি গড়ে তুলছেন।
শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং তাদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা আবশ্যক। জেন-জি ও আলফা প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক সিলেবাসের বাইরে বের হয়ে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তা করতে খুব পছন্দ করে। শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা করতে উৎসাহিত করছেন এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে তুলতে সহায়তা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রজেক্ট-ভিত্তিক শিক্ষা (Project based learning) এবং সমস্যা সমাধানের শেখার পদ্ধতি (Problem-based learning) বাংলাদেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে চলেছে।
প্রযুক্তির সুবিধা যেমন বাড়ছে, তেমনি এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। তাই দায়িত্ববান শিক্ষকবৃন্দ প্রযুক্তির সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার শেখাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার শিক্ষাদান শিক্ষকদের জন্য একটি বড় দায়িত্ব।
বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরীক্ষার চাপ, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি করছে। সম্প্রতি আচল ফাউন্ডেশন নামক একটি সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে আগষ্ট পর্যন্ত ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৩১৪ জনই স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। শিক্ষকবৃন্দকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা
প্রজন্ম জেন-জি ও প্রজন্ম আলফা এর শিক্ষার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষকদেরও আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। বিশেষ করে ই-লার্নিং এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতিমালা এবং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। শিক্ষা নীতিমালায় প্রযুক্তির ব্যবহার, সমালোচনামূলক চিন্তাধারা, এবং বাস্তবমুখী শিক্ষার উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারকে শিক্ষার নৈতিকতা ও মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
উদ্ভাবনী শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী প্রকল্প, গবেষণা এবং অন্যান্য সৃজনশীল কার্যক্রমের জন্য তহবিল সরবরাহ করা প্রয়োজন। সরকারকে STEM (Science, Technology, Engineering, and Mathematics) বিষয়ে গবেষণা এবং শিক্ষার উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকদের প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা, রাষ্ট্রের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ, উদ্ভাবনী এবং সমাজের জন্য ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত নিম্নমানের। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে সবচেয়ে বেশী। চীন, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মালেশিয়া, পাকিস্তানে শিক্ষকবৃন্দের বেতন সরকারী অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকে পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা ও ইনসেনটিভ প্রদান করে থাকে। আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় সরকারি, বেসরকারি এমপিওভুক্ত ও মাদরাসা শিক্ষা সহ নানারূপ ধারায় প্রচলিত। আমাদের দেশের বিশের করে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকবৃন্দ আর্থিক বৈষম্যের স্বীকার। তাইতো শিক্ষকতা পেশার আর্থিক নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার কারণে মেধাবীরা বরাবরই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের লালিত বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষক সমাজ সোচ্চার হলেও বিগত সরকার বা যথাযথ কতৃপক্ষ এদিকে কর্ণপাত করেননি যা অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক। তবে গোটা দেশে শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কষ্টার্জিত স্বাধীনতার ফসল ও প্রত্যাশিত বর্তমান সরকার এই শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি শিক্ষকবৃন্দের সম্মান উন্নয়ন ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
খুরশীদুজ্জামান আহমেদ
প্রধান শিক্ষক,
কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়
কালীগঞ্জ, লালমনিরহাট।