২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে ১.৮১ শতাংশে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকেও প্রবৃদ্ধি তেমন বাড়বে বলে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। সরকারি পরিসংখ্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে।
অর্থনীতিতে নিম্নগতি স্পষ্ট। প্রথম চার মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৭.৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ সময়ে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও কমেছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র ২৬ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আহরণ কমেছে ২.৬২ শতাংশ। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। এদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়িয়ে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে।
প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি: এক উদ্বেগজনক চিত্র
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ১.৮১ শতাংশে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকেও এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার সম্ভাবনা নেই। সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে এই চিত্র উঠে এসেছে।
অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। প্রথম চার মাসে এ হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭.৬৬ শতাংশে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির পরিমাণও নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র ২৬ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে দেশে নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।
রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণনির্ভরতা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ২.৬২ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪.২৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৬৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের হার বেড়েছে। সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১২.২৫ শতাংশ থেকে ১২.৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা আরও বেশি অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
ভ্যাট বৃদ্ধি: কারণ ও প্রভাব
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে ভ্যাট বৃদ্ধির কথা বলা হলেও মূল সমস্যা হলো রাজস্ব ঘাটতি। প্রথম চার মাসে শুল্ক ও কর আদায়ের ঘাটতি ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। এমনকি আগের বছরের তুলনায় এই সময়ে রাজস্ব আদায়ও কমেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত পৃথিবীর অন্যতম সর্বনিম্ন। গত ১৫ বছরে দেশের জিডিপি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেলেও রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত কমেছে। এর মধ্যে আবার প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের অবদান খুবই কম। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর সমান প্রভাব ফেলে এমন করের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা রাজস্ব নীতির দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে।
মূল্যস্ফীতি এবং স্ট্যাগফ্লেশন
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে এতে ঋণের সুদ বাড়লেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। উল্টো নীতি সুদহার বৃদ্ধি এবং ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশনের (উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ বেকারত্ব) পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র সুদহার বাড়ানো বা ভ্যাট বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের অবনতি
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে, কর্মসংস্থানের সংকট আরও প্রকট হয়েছে। গত এক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যেও কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। এখন নিম্ন প্রবৃদ্ধির মধ্যে এই সংকট আরও বেড়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আস্থার সংকট
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরু হলেও আস্থার অভাব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠীর ওপর ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজস্ব ফাঁকি এবং অর্থ পাচার
বাংলাদেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। কর ফাঁকির অর্থের বড় অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবশালী মহলের কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে রাজস্ব ঘাটতি আরও বেড়েছে। উপরন্তু, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে কর ফাঁকিতে এক ধরনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের অভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনার মতো কার্যকর পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকার এখনো নিতে পারেনি। ধনীকেন্দ্রিক নীতির সমালোচনা যেভাবে আগের সরকারের ক্ষেত্রে করা হতো, ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও সেই ধাঁচে নেওয়া হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতি, বিনিয়োগের অভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বেকারত্বের সমস্যা অর্থনীতির সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে তুলছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন। তা না হলে অর্থনীতির এই নিম্নমুখী প্রবণতা আরও গভীর সংকটে পরিণত হতে পারে।